চশমাটা খুলে এর মধ্যে লেগে থাকা সব ঘাম পাঞ্জাবিতে পরিস্কার করতে করতে নুহাশ বলল "হইসে তো । আর কত বই কিনবা? "গরম এতটাই বেশি যে পাঞ্জাবি ঘামে পিঠে লেপটে আছে।
তার দিকে ভ্রু কুঁচকে নাবিলা পাল্টা প্রশ্ন "খুব বেশি কিনে ফেললাম মনে হয়? " চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে যেন তার।
"দেখতেই তো পারছ! এবার কিনলে আমি আর ধরতে পারব না,আমার তো আর দুর্গার মত ১০ টা হাত না। " হঠাৎ নুহাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নাবিলা মনে মনে ভাবল "ঠিকই তো। বেচারা চাইলেও আর বইয়ের ব্যাগ ধরতে পারবে না" এইটা ভেবে নাবিলার রাগ সম্পূর্ণ নেমে গেল। কিন্তু তা নুহাশকে বুঝতে না দিয়েই বলল "তুমি না ধরলে নাই ।
আমার বই আমিই বহন করব ।তাহলে তো আর তোমার সমস্যা হওয়ার কথা না। " এই বোলে নাবিলা পুনরায় বই কিনায় মনোনিবেশ করলো । "ঊফফ.........না আর এই গরমে থাকা সম্ভব না। প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেয়েছে তার । দেখা যাক মেলায় কোথাও পানি পাওয়া যায় কিনা !!" নুহাশ আপনমনেই বোলে উঠল এবং পানি খোজার উদ্দেশে রউনা হল । কাছেই একটা ফাস্টফুডের দোকান থেকে একটা কোক কিনল। দোকানদারকে ৪০ টাকা দিতেই সে একটি ৫ টাকার ,একটি ২ টাকা এবং একটি ১ টাকার চকলেট দিলো । কোকের দাম ৩২ টাকা, এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার তার পান খাওয়া হলুদ দাঁতের হাসি দিয়ে বললেন "মামা, ১ টাকা ভাংতি নাইক্কা। এই চকলেটটা লইয়া যাও । " মাথার ভিতরে মগজটা যেন ফুটন্ত গরম পানির মত ফুটছে । নুহাশের মন চাচ্ছে যদি ঘুসি মেরে লোকটার দাঁত ফেলে দিতে পারত। এটা দোকানদারদের নতুন ব্যবসা ।ভাংতি থাকা সত্ত্বেও না থাকার কথা বোলে একটা চকলেট বিক্রি । কেউ লজ্জায় পড়ে একটাকা চাইতেও পারে না,এর সুযোগই নেয় দোকানদাররা। ঘুসি মারতে গিয়েও অবশেষে ঘুসি মারা হল না ,তার থেকে কোকটা খুলে গলা ভিজানোকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হল তার কাছে। দোকানের বাইরে এসে একটু খালি জায়গায় এসে দাড়িয়ে কোক খেতে শুরু করলো নুহাশ। চারদিকে অনেক লোক, বিশেষ এই একটি মাস বাংলা একাডেমী যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে ।সূর্যের তেজ, রাস্তার জ্যাম ,লোকজনের ভিড় কিছুকেই যেন এরা পরোয়া করে না । নাবিলা র্এখনও বই কিনায় ব্যাস্ত ।মেয়েটা পড়তে অনেক ভালবাসে ।যখন কেনা বই শেষ হয়ে যাবে ও খবরের কাগজও পড়া শেষ হয়ে যাবে তখন পড়া কাগজকেই আবার পড়বে । তার জগতে বইয়ের থেকে মূল্যবান আর কিছু আছে বোলে মনে হয় না। রোদের তেজ নুহাশের ভাবনায় ছেঁদ ফেলল। রোধ থেকে বাঁচতে নুহাশ একটা গাছের নিচে গিয়ে দাড়ায়।
ঠিক এরকমই একদিনে নাবিলার সাথে দেখা তার । রোদের তেজে যখন নুহাশের প্রান ওষ্ঠাগত ,তখন সে ভার্সিটির সামনে একটি গাছের নিচে বসে গান ধরে । JOHN DENVER এর ANNIE'S SONG । কিছুক্ষণ গাওয়ার পর একটি মেয়ে গলা শুনে থামতে হল "বাহ! আপনিতো অনেক ভালো গান গাইতে পারেন।অবশ্য গানটা এতো সুন্দর তাই এটা যেই গাক না কেন ভালি লাগবেই!!"মেয়েটার দিকে তাকালে প্রথম যে জিনিসটা চোখে পড়বে তা হল তার চোখ । চোখ দুটা একটু বেশিই ছোট ।কিন্তু তার চেহারার সাথে তা চমৎকার ভাবে মানিয়ে গেছে। এবার নুহাশ প্রশ্ন -"এটা আপনের প্রিয় গান মনে হয়? "
"হা,প্রিয় গান,কিন্তু আমার প্রিয় গায়ক জেবি।" নাবিলার জবাব।
"জেবি? U mean Justin Bieber ??ওই গে টা??"
"হেই,watch it,huh!! ও মোটেও গে না। একটু বেশি সুন্দর দেখতে,তাই সব ছেলেরা ওকে হিংসা করে এসব আজে বাজে নাম দিসে । "
এভাবেই শুরু তাদের ।সম্পর্কটা এখনও তেমনি আছে ।শুধু সময়ের সাথে আরও পরিণত হচ্ছে । এখনও কেউ কাউকে নিজের মনের কথা বলেনি।কিন্তু দুইজনই তা বুঝে।তাই কারোই কাউকে বলার প্রয়োজন হয়নি।
এসব ভাবতে ভাবতে নাবিলার দিকে তাকাতেই তার রাগে যা জ্বলে উঠল। ভিড়ের মধ্যে একটা ছেলে ইচ্ছা করে নাবিলার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে ।আবার কখনওবা গায়ের সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে । তা দেখে নুহাশের রাগে গা জ্বলে উঠল। দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার কলার ধরে বলল "ওই , ফাজিল। তোর সমস্যা কি? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি তোকে। মেয়েদের দেখলে শরীর ঠিক থাকে না,তাই না?"
"আরে ভাই, আপনে আমার কলার ধরছেন কেন? ভিড়ের মাঝে তো একটু ধাক্কা লাগতেই পারে,তাইনা? "বোলে এমন এক হাসি দিলো যেন ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে পারে না। নুহাশ আর সহ্য করতে পারল না ।ঠিক নাক বরাবর ঘুসি বসিয়ে দিলো । ফলস্রুতিতে যা হবার তাই হল , হাতাহাতি লেগে গেল।দুপাশের মানুষ খুব কষ্টে তাদের ছাড়িয়ে নিল । নাবিলা নুহাশের হাত ধরে টেনে সেখান থেকে নিয়ে আসলো। আসার পথে রিক্সায় নাবিলা নুহাশের সাথে একটা কথাও বলল না। বাসার সামনে রিক্সা থামিয়ে নিজের বইয়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে হনহন করে বাসায় চলে গেল ।নাবিলাকে নামিয়ে দিয়ে নুহাশ ভাবতে লাগলো যে কাজটা কি ঠিক হল কিনা? না, ঠিকই আসে। এসব নর্দমার কীটরা এমন ব্যবহারই প্রাপ্য ।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিতে ১০০ টাকা দিতেই রিকশাওয়ালা বলে ভাংতি নেই । আবার সেই ভাংতি,উফফফ......অসহ্য। সামনেই একটা ভ্যান দেখল যেখানে মাইক লাগিয়ে লটারির টিকেট বিক্রি হচ্ছিল।১০ টাকা প্রতি পিস। লটারির লোভ না ,ভাংতি করার জন্যই সে একটি টিকেট কিনল । ভাংতি পেয়েই নুহাশ রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে টিকিটটার দিকে তাকাল। টিকেটের নাম্বার হল ন ন ১৬২৩, বাহ!খুব সুন্দর নাম্বার তো ।ন তে নুহাশ,আরেক ন তে নাবিলা,১৬ অক্টোবর নুহাশের জন্মদিন,২৩ নভেম্বর নাবিলার ।টিকেটটা যেন তাদেরই জন্য তৈরি। টিকেটটা উল্টে পাল্টে দেখে নুহাশ চক্ষু চড়কগাছ। ১ম পুরস্কার ২৫ লক্ষ তাকা,২য় ও ৩য় পুরস্কার যথাক্রমে ১৫ ও ১০ লক্ষ টাকা।ইশ... একটা যদি পেয়ে যেতাম ,ভাবতে ভাবতেই মেসে পৌঁছে গেল নুহাশ।
নুহাশ যেই না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে তখনি মিরাজ ভাইএর ডাক । "কিরে নুহাশ,আজকাল তোকে দেখা যায় না । কি করছিস? "মিরাজ ভাই এই মেসের মালিক। এলাকায় তার যথেষ্ট প্রভাব । ২ বার ইলেকশানে দাঁড়িয়েছিলেন ।যদিও দুইবারই হেরেছেন। কিন্তু নতুন উদ্দমে ৩য় বারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন ।
"হা,আজকাল একটু ইন্টার্ভিউ নিয়ে একটু ব্যস্ত ।"
"আরে রাখো মিয়াঁ তোমার ইন্টার্ভিউ। আমার সাথে মিথ্যা বলবা না। সাদেক তোমারে আজ বাংলা একাডেমীতে দেখসে। কোন পোলারে বলে মাইরা নাক ভাইঙ্গা দিছ ? সাথে নাকি ওই চাকমা মাইয়াও ছিল, কি জানি নাম? "
"নাবিলা" বলেই নিচের দিকে তাকাল নুহাশ ।
"নাবিলা হক,কাবিলা হোক। আমার জানার দরকার না, আমার দরকার হল ভাড়া ।তোমার ৩ মাসের ভাড়া বাকি । আজ মাসের ১৩ তারিখ ।তুমি যদি ১৫ তারিখের মধ্যে মেস ছেড়ে যাবা গিয়া ।আর হ্যা,জিনিস পত্র রাইখা যাবা, ওইগুলা বেইচা এতদিন যে মাগনা থাকলা তার ভাড়া উসুল করমু । বুজছ?" নুহাশ নিরবে মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে গেল। ২ বছর আগেও নুহাশদের এমন অবস্থা ছিল না। বাবা সরকারি চাকুরী করে যা পেত তা দিয়ে মোটামুটি চলে যেত । কিন্তু হঠাৎ বাবার মৃত্যু সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। অনেক কষ্টে ধারদেনা করে সে মাস্টার্স কমপ্লিট করে । কিন্তু বহু ইন্টার্ভিউ দিয়েও চাকরি পায়না। টিউশনি করে যা পায় তা সবটুকুই ধার ও ছোট বোনের লেখাপড়ার খরচ হিসেবে গ্রামে পাঠিয়ে দিতে হয়। আজ সব টিউশনি থেকে কিছু করে টাকা আডভান্স নিতে হবে তাছাড়া আর কোন উপায় নেই।কিছুখন পরই মেসের বুয়া খাবার দিয়ে গেল ।খাবার বলতে ভাত ও ডাল ।সক্ত সেই চাল অর্থাৎ ভাতের সাথে হলুদ পানি অর্থাৎ ডাল মিশিয়ে খেতে লাগলো। এমন সময় নাবিলার মেসেজ ,"এক সপ্তাহের জন্য নোয়াখালী যাচ্ছি ।সেখানে মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকে না। তাই মোবাইল অফ থাকবে,ভাল থেক।"নয়াখালি,নাবিলার গ্রামের বাড়ি। টেক্সট দেখে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলো নুহাশ।
নুহাশের দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে পড়ছে। আজ ১৪ তারিখ। কোনখান থেকে টাকা যোগাড় হয়নি। নিজের টাকার পরিমান দেখতে মানিব্যাগ খুলল নুহাশ ।মোট ১০৫ টাকা ।সাথে ভাজ করে রাখা সেই টিকেট । হঠাৎ নুহাশের মনে পড়ল যে আজ টিকেটের ড্র ।ভাংতি ৫ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনল নুহাশ । প্রথম পুরস্কার পেয়েছে ছ ম ৩৪২১ ,নুহাশের মন খারাপ হয়ে গেল ।দ্বিতীয় পুরস্কার ক ল ১২৩১,নুহাশের আবার আশাহত হল ।না,নুহাশের ভাগ্য এতো ভালো না যে লটারি পাবে। তবুও মনে খচখচ নিয়েই ৩য় পুরস্কারের নাম্বার চেক করলো । ন ন ১৬২৩, নুহাশের নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না,আবার সে স্টেপ তো স্টেপ মিলাল।না কোন ভুল নাই। ন ন ১৬২৩ ,নুহাশের টিকেটই ত।নুহাশ চিৎকার দিয়ে দৌড়ে মিরাজের রুমে গেল। মিরাজকে সব ঘটনা খুলে বলল ।মিরাজ প্রথম বিশ্বাস না করতে চাইলেও পরে টিকেট ও পেপার দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।
টাকার ব্যাগ নিয়ে বাসার উদ্দেশে রউনা করেছে নুহাশ। এই টাকা গুলা দিয়ে ঢাকায় একটা ছোট ব্যবসা দিবে। তাছাড়া মা ও বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসবে ।পায়ের মাটির নিচ শক্ত হউয়ায় এখন নাবিলাকে নিয়ে তাদের সম্পর্ককে বিয়েতে পরিনত করতে পারবে । কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে কিসের যেন প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পড়ল ।মাথায় প্রচণ্ড আঘাতে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো ।যতক্ষণ হুঁশ ছিল হাত দিয়ে শক্ত করে ব্যাগটা ধরে রেখেছিল সে ।যখন স্বপ্ন পুরন নাই করতে পার তাহলে এরকম স্বপ্ন দেখিয়ে পরিহাস কর কেন খোদা?
নাবিলার সামনে আজকের খবরের কাগজ । সেখানে পেজ এর কিনারে একটি ছোট কলামে নুহাশের ছবি ।হেডলাইনে লেখা "অর্থই মৃত্যু" ,খবরের সারসংক্ষেপ এইযে কালরাত ৭ টার সময় এক ট্রাক ইচ্ছাকৃত ভাবে রিক্সাকে ধাক্কা দিয়ে যায় ।ইচ্ছাকৃত বোলার পিছনে কারন হল রিক্সাওয়ালার ভাষ্য "সাইডে জায়গা থাকতেও ট্রাক ধাক্কা দেয়। আমার ভাগ্য ভালো থাকায় বাইচা গেছি।"কিন্তু নুহাশের ভাগ্য ভালো ছিল না। সে চলে গেছে,বহুদুর ,অজানার দেশে। নাবিলা বাকরুদ্ধ ।আজ সে কিছুই বলতে পারবে না ।বলার ক্ষমতা তার আজ আর নাই।ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে না পারা এ কেমন পরিহাস?
মিরাজের সামনে ১০ লক্ষ টাকা।
"এইখানে ৮ লক্ষ টাকা আমার এবং ২ লক্ষ তোর, যেহেতু ট্রাক চালিয়েছিস তাই বকশিশ।" দুজনের মুখে ক্রুর হাসি। ভাজ্ঞদেবতার এ কেমন পরিহাস?
১১ অক্টোবর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪